Friday, November 20, 2015
খবরের
জন্ম মৃত্যু
তিনি কে
এ নিয়ে প্রশ্নটা ছিলই। উত্তর ? সব প্রশ্নের সঠিক উত্তর কি আর জানা, উত্তর জানতেই
তো পথ চলা বলতেন সবজান্তা ঈশ্বর কাকা।
যদিও খুব পরিষ্কার করে লোকটির সম্মন্ধে কাকা কোনো সদুত্তর দিতে পারেন নি। এ পাড়া যেখানে শেষ হল,ঠিক যার পাশেই নদী বহমান, সেখানে একটা ভাঙা ঘরে ছিল ঈশ্বর
কাকার বাস।। আর লোকটি থাকতেন হারুদের বাড়ির পাশে যে নিম গাছটা মাথা তুলে দাঁড়িয়ে
তার ঠিক লাগোয়া দোতলা বাড়িটায়। আমাদের
কাকা সর্বজ্ঞ বলেই পরিচিত ছিলেন। কাকা বলত
– ‘লোকটা
ভাল বা মন্দ,দুই এর যে কোনো একটা। তবে লোকটি খুব স্বাভাবিক নন মোটেই। কাকার কথা
শুনে বোঝা যেত যা বলছেন তা স্পষ্টতই
অনুমাননির্ভর,কারণ তাতে আত্মবিশ্বাসের অভাব প্রকট। বলার সময়ে তার মিষ্টি হাসি ছড়িয়ে দিতেন কাকা।
আমরা বলতাম ম্যানেজ দিচ্ছেন ,মানে ম্যানেজার।
বড়রা বকতেন খুব- ‘এমন কেউ বলে
ত্রিকালজ্ঞ সম্মন্ধে,ছি ! অনেক রাত অবধি
তার ঘরে জ্বলত আলো। সামান্য খোলা দরজা দিয়ে সে আলো ত্রিভূজাকৃতি হয়ে বাইরে এসে শিস
দিত। যারা ঘুমিয়ে পড়ত তারা ভাবত চৌরাশিয়ার বাঁশির সুর।এরা আসলে আপন-সুখী
মানুষ।অন্য লোক নিয়ে অযথা ভেবে সময় নষ্ট করায় এদের কোনো ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু যারা জেগে থাকত,তারা তাকে নিয়ে গভীর
আলোচনায় ব্যস্ত থাকত রাতের পর রাত। কেউ বলত ঈশ্বর হয়তবা। কেউ বলত শয়তান। অনেকেই
বলত লোকটা আদতে এক সন্ত্রাসবাদী। সন্ত্রাসবাদের লম্বা হাত
তখন আমাদের এই মফস্বল কেও ছুঁতে শুরু করেছে। নইলে ত্রিভূজ আলোর মাঝে কাদের যেন ছায়া সরে
যেত,কেন? তিনি যে ঠিক কি এ জানার আগেই
ঘটনাটা ঘটে গেল,নইলে হয়ত জানা যেত তিনি কে,কি বা কেন,কেনই বা তিনি রাত জাগেন। এহেন
রাত জাগার ঘটনা টা সত্যি হোক বা মিথ্যে,ঘটনাটা ঘটে ছিল। নইলে এত লোক বলে কখনো। এটা
হল ম্যালথাস থিওরির এক্সটেনসন, যেখানে জনগণ যা বলছে তা সর্বৈব ভাবে মেনে নেওয়াটাই
রেওয়াজ।
লোকটা
ভাল ছিল না মন্দ তা নিয়ে অবিশ্যি বুড়ির মার আগ্রহ ছিল,আবার ছিলও না।বুড়ির মা ছিল ঠিকে কাজের লোক। লোকটার বাড়ির দালান আর সিঁড়ি
মোছার দায়িত্ব প্রাপ্ত ছিল সে। ঘর থাকত তালা বন্ধ ।নইলে ভেতরে ঠিক কি হয় বুড়ির মা
অবশ্যই জানাত। বুড়ির মার বাড়ি ছিল এ পাড়ার জেলে বস্তিতে। তার স্বভাবগত গুণ ছিল
দুটি। এক সোমবার সোমবার বাবার মাথায় জল না ঢেলে মুখে কিছু না তোলা। আর কাজের
বাড়িতে ফাঁক ফোকরে জিনিস সাবাড় করা। তবে
বুড়ির মা অবশ্য বলতেন –‘নাগো মানিষ টা ভালো। কই আমার টাকা তো মারেনি কখনো’। মাস পয়লায় টেবিলের ওপর পেপার ওয়েট
চাপা থাকত মাইনে টা। বুড়ির মা কেবল এই একটি মাত্র বাড়িতেই ফাঁকা পেলেও চুরি করবার
কথা ভাবেনি। কারণ লোকটা হয়ত ভগবান,নয় শয়তান। ঈশ্বর কাকা বলতেন ‘তাহলে লোকটা
ভালই হয়তবা’।যা শালা এ কেমন
উত্তর হল কাকা? কাকা হাসি দিত।ঘটনাটা কিন্তু ঘটে ছিল নইলে এসব কথা আসবেই বা কেন।
কার্তিক বলেছিল
লোকটা খুব পড়াশুনা জানা। নইলে এত্ত গুলো পেপার নেয়। লোকটির বাড়িতে প্রভাতী সংবাদ
পত্র পৌঁছে দেবার দায়িত্ব ছিল তার। ঈশ্বর
কাকা বলেছিল –‘পেপার নিলেই যে পড়ে
তার খবর কে রাখে হে’! হে হে করা ভক্তকুল
বলেছিল – ঠিক ঠিক। কার্তিক এ
সব নিয়ে মাথা ঘামাত না। লাভ কি হে। আদার ব্যাপারী জাহাজের খবরে কাম কি ! লেটার বক্সে ফাঁকে কাগজ ঢুকিয়ে চলে যাওয়া ছিল
তার কাজ। আর মাস শেষে বিল লেটার বক্সেই রেখে যেত কার্তিক। পরদিন একটা খামে ভরে টাকা
রাখা থাকত। কার্তিকের সুবিধে ছিল এই যে দুই বা
চার টাকা বেশী থাকলে তাকে সেটা ফেরত দিতে হত না। লোকটা ভালই ছিল। আর ঘটনাটাও কিন্তু ঘটেছিল। আর যা হয় লোক জন
গসিপ,জ্ঞান,বিজ্ঞা...
হারান দা
বলত –‘লোকটা আসলে ভুত প্রেত কেউ হবে’। - হ্যাঁগা হারান দা তা ভুত প্রেত রোজ হাফ লিটার দুধ
খেয়ে নেয়?’ ইশ্বর কাকা বলতেন –‘ভুত প্রেত দত্তি দানো, সব বলে আমায় জানো’। - ‘তা কাকা, এ লোক তো কিছুই জানায়
না,এ কেমন হল কথা’। কাকার হাসি।
ম্যানেজার তো। এমন লোকরা অবশ্য ম্যানেজারই হয়। হারান দার জন্য রাখা থাকতো একটা
ঝোলানো ব্যাগ। তাতে মেট্রো ডেয়ারির প্যাকেট টা ফেলেই দৌড় দিতো হারান দা। - ‘হারান দা ওই ব্যাগের থেকে দুধ টা উঠিয়ে নিতো কিনা
দেখেছ?’ হারান দা বলত –‘ধুর ! অত সময় আছে নাকি। ওসব দানোয় পাওয়া লোক। ঠিক নেয়
রে নেয়’। আসলে ঘটনাটা ভাগ্যিস ঘটল।নইলে আমাদের মফস্বল শহরে
গসিপের যে কি খরা দেখা দিয়েছিল।
সেদিন
ছিল রৌদ্রোজ্জ্বল সকাল। ঠিক যেন ৬ জুন হিরোসিমার সকাল। লোক জন বেরিয়ে পড়েছে রাস্তায়। তখন সকাল পৌনে আট হবে। সাইরেন বাজল। আমেরিকান
বোমারু বিমান যেমন রোজ টহল মেরে যায় মেরে গেল। যারা ভীতু তারা বাঙ্কারে ঢুকে গেল।
যারা সাহসী তারা ডোন্ট কেয়ার। বাচ্চারা মায়ের হাত ধরে চলেছে ইস্কুলে। যাবার পথে
কিনে নিচ্ছে চিপস বা ওরিও বিস্কিট। বাবারা অফিস বেরুলো । যুবক যুবতীরা দাঁত না মেজেই ফেসবুক হোয়াটস অ্যাপ খুলতে শুরু
করেছে। ঈশ্বর কাকা দূর্গা বেদিতে বসে, সামনে খোলা খবরের কাগজ,শুরু হয়েছে সার্বজনীন
জ্ঞান বিতরণ। রেবা পিসী কলতলায় খিস্তির ফোয়ারা
ছোটানো শুরু করবে ভাবছে সবে।আমাদের টাউনেও ঠিক এই সময়ে যায়
পৌরসভার মল বওয়ার গাড়ি। সবাই এ
সময়ে বাঙ্কার মানে বাড়িতে ঢুকে পড়ে অথবা পড়ে না। গাড়ি চলে গেল আবার লাল নীল সবুজ
বেলুন উড়ছে। সময় টা আট টা বাইশ কি তেইশ। আর তীব্র আলোর ঝলকানি। কি যেন হল। প্রথম
পরমাণু বোমা পড়ল বুঝি। এবার ভীড় বাড়ছে। ঘন্টি, নন্টিছাতু,লাটু ইন্নি বিন্নি
কাকা,মাসী,পিসি সব্বাই হাজির। যাক খরা মিটল। লোকটা পড়ে রয়েছে বাড়িটার সামনে উপুর
হয়ে। কানের পাশ দিয়ে রক্ত। তিনটে গুলি। পর পর। কে কারা কেন। কিচ্ছু বোঝা যাচ্ছে
না।ফ্লাশ বাল্বের ঝলকানি। পিঠে ব্যাগ সাংবাদিক। ইশ্বর কাকা বাইট দিচ্ছে এসিপি
নিরানন্দ কে। বাহাত্তর ঘন্টা কে দিচ্ছে হারান দা। বুড়ির মার ফটো তুলছে কারা যেন।
মাও না ম্যাও যোগ ছিল কে যেন বলল পাশ
থেকে। কে যেন বলল থে - ‘আই
এস’। ঈশ্বর কাকা হাসছেন। বুঁচু কত আর
হবে বড় জোর পাঁচ স্কুল যাবার পথে মাকে জিজ্ঞেস করছে –‘মা লোকটা কি দুষ্টু ছিল খুব? মা কপালে তর্জনি ঠেকিয়ে
বলল – বলতে নেই,প্রণাম কর।
পুলিশের
গাড়ি চলে গেছে।পৌর সভার জমাদার এসে রাস্তা পরিস্কার করে দিল। যাওয়ার আগে ও পরে লোকজনের
জটলা। জটিল জটলা। গড়াচ্ছে। বল বড় হচ্ছে,
গড়াচ্ছে।
বলা হয়
নি। বাড়িওলা নতুন ভাড়াটে পেয়েছেন অনেক কাঠ খড় পুড়িয়ে। সত্য নারায়ণের সিন্নি দিয়ে
তবে ঘরে ঢুকেছে নতুন লোক। তবে লোক জন বলে রাত বাড়লে নাকি সেই
ত্রিভুজাকৃতি আলোটা আগের মতই বাইরে এসে পড়ে। ঈশ্বর কাকা তাই নিয়ে আবার বুলি ছাড়ছে। বুড়ির মা আবার বহাল হল কিনা জানা যায়নি।
তবে কার্তিক আর হারান আগের মতই কাগজ আর দুধের দায়িত্বে।
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
0 comments:
Post a Comment