• কবিতা সুর্মা


    কবি কবিতা আর কবিতার কাজল-লতা জুড়ে যে আলো-অন্ধকার তার নিজস্ব পুনর্লিখন।


    সম্পাদনায় - উমাপদ কর
  • সাক্ষাৎকার


    এই বিভাগে পাবেন এক বা একাধিক কবির সাক্ষাৎকার। নিয়েছেন আরেক কবি, বা কবিতার মগ্ন পাঠক। বাঁধাগতের বাইরে কিছু কথাবার্তা, যা চিন্তাভাবনার দিগন্তকে ফুটো করে দিতে চায়।


    সম্পাদনায়ঃ মৃগাঙ্কশেখর গঙ্গোপাধ্যায়
  • গল্পনা


    গল্প নয়। গল্পের সংজ্ঞাকে প্রশ্ন করতে চায় এই বিভাগ। প্রতিটি সংখ্যায় আপনারা পাবেন এমন এক পাঠবস্তু, যা প্রচলিতকে থামিয়ে দেয়, এবং নতুনের পথ দেখিয়ে দেয়।


    সম্পাদনায়ঃ অর্ক চট্টোপাধ্যায়
  • হারানো কবিতাগুলো - রমিতের জানালায়


    আমাদের পাঠকরা এই বিভাগটির প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বীকার করেছেন বারবার। এক নিবিষ্ট খনকের মতো রমিত দে, বাংলা কবিতার বিস্মৃত ও অবহেলিত মণিমুক্তোগুলো ধারাবাহিকভাবে তুলে আনছেন, ও আমাদের গর্বিত করছেন।


    সম্পাদনায় - রমিত দে
  • কবিতা ভাষান


    ভাষা। সে কি কবিতার অন্তরায়, নাকি সহায়? ভাষান্তর। সে কি হয় কবিতার? কবিতা কি ভেসে যায় এক ভাষা থেকে আরেকে? জানতে হলে এই বিভাগটিতে আসতেই হবে আপনাকে।


    সম্পাদনায় - শৌভিক দে সরকার
  • অন্য ভাষার কবিতা


    আমরা বিশ্বাস করি, একটি ভাষার কবিতা সমৃদ্ধ হয় আরেক ভাষার কবিতায়। আমরা বিশ্বাস করি সৎ ও পরিশ্রমী অনুবাদ পারে আমাদের হীনমন্যতা কাটিয়ে আন্তর্জাতিক পরিসরটি সম্পর্কে সজাগ করে দিতে।


    সম্পাদনায় - অর্জুন বন্দ্যোপাধ্যায়
  • এ মাসের কবি


    মাসের ব্যাপারটা অজুহাত মাত্র। তারিখ কোনো বিষয়ই নয় এই বিভাগে। আসলে আমরা আমাদের শ্রদ্ধা ও ভালবাসার কবিকে নিজেদের মনোভাব জানাতে চাই। একটা সংখ্যায় আমরা একজনকে একটু সিংহাসনে বসাতে চাই। আশা করি, কেউ কিছু মনে করবেন না।


    সম্পাদনায় - নীলাব্জ চক্রবর্তী
  • পাঠম্যানিয়ার পেরিস্কোপ


    সমালোচনা সাহিত্য এখন স্তুতি আর নিন্দার আখড়ায় পর্যবসিত। গোষ্ঠীবদ্ধতার চরমতম রূপ সেখানে চোখে পড়ে। গ্রন্থসমালোচনার এই বিভাগটিতে আমরা একটু সততার আশ্বাস পেতে চাই, পেতে চাই খোলা হাওয়ার আমেজ।


    সম্পাদনায় - সব্যসাচী হাজরা
  • দৃশ্যত


    ছবি আর কবিতার ভেদ কি মুছে ফেলতে চান, পাঠক? কিন্তু কেন? ওরা তো আলাদা হয়েই বেশ আছে। কবি কিছু নিচ্ছেন ক্যানভাস থেকে, শিল্পী কিছু নিচ্ছেন অক্ষরমালা থেকে। চক্ষুকর্ণের এই বিনিময়, আহা, শাশ্বত হোক।


    সম্পাদনায় - অমিত বিশ্বাস

Friday, November 20, 2015

অরুনকুমার সরকার

অরুনকুমার সরকার

(কাব্যগ্রন্থ-  দূরের আকাশযাওউত্তরের হাওয়া )


Every Artist Dips His Brush in His Own Soul, and Paints His Own Nature into His Pictures

একজন শিল্পীর দৃষ্টি ও সৃষ্টির মধ্যবর্তী ফাঁকটূকুতে বোধহয় আদতে শিল্পী নিজেরই আত্মপ্রতিকৃতির অনলস সন্ধান করে থাকেন এমনটাই ভাবতেন মার্কিন দার্শনিক হেনরী বীচার। সুক্ষভাবে দেখলে এই অসহয়তাই বোধহয় জীবনব্যাপী একজন কবিকেও তাড়িয়ে ফেরে প্রকৃতি ও মানুষের সংযুক্ত আর্তির হাত ধরে। ফলে এই যে চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা হাজার লক্ষ নিয়ুত কোটি কবিতার মিশ্র সুর তার কোথাও যেন কবির একটি মৌলিক টেস্টামেন্ট রয়ে যায় কিংবা কবি নিজেই তার এই সীমাবদ্ধ আমিটাকেই শব্দের উপমায় বোধের অনুভবের ব্যঞ্জনায় সীমা পার করাতে চান।  কিন্তু সেই আমির পলেস্তরাটা যাবে কইসে তো যেকোনো শিল্পের দ্বন্ধময় স্মারক এবং যেকোনো স্রষ্ঠার হাত থেকে শিল্পের মুক্তি ঘটলেও শিল্পের হাত থেকে শিল্পীর ওই ভেজা মুখটি  ওই নির্জন প্রতিধ্বনিটি মুক্ত হতে পারে না পুরোপুরি । নন্দলাল যেমন বলতেন- যে শিল্পী গতি ভালবাসে তার ছবিতে গতির ছাপযে রূপ ভালবাসে তার ছবিতে রূপের কথাযে ভাব ভালবাসে তার ছবিতে ভাবের প্রকাশ থাকেছবি সমাপ্ত হবার পরও।-ঠিক তেমনি শব্দের সংসা্রে কবির দার্শনিক অনুপ্রাসের সাথে সাথে কিছু ব্যক্তিগত পিচ টোন টেম্পোর স্বরগ্রামও স্পষ্ট হয়ে ওঠে , গাঢ় হয়ে ওঠে হৃদয়ের রসদ। যেকোনো ভাবনার প্রাথমিক ভিক্ষাভাষাই কিন্তু এই জীবিত বাস্তবটুকু। আর কবি অরুনকুমার সরকারের কবিতায় এলিমেন্টাল হয়ে উঠেছে অনুভূত জীবনের মর্মছেঁড়া এই আত্মপ্রতিকৃতিগুলো।  আসলে কোনো শূন্যভাষার কাছে শব্দের ভিক্ষাপাত্র নিয়ে হাজির হননি অরুনকুমার বরং তাঁর কবিতায় জীবন বারংবার জীবনকেই বহন করে ফিরছে। তিনি নিজে লিখেছেন সব কবিতাই পুনর্লিখিত কবিতা-মনে পড়ে যাচ্ছে ঠিক আগের সংখ্যায় কবি সুমিতেশ সরকারকে নিয়ে আলোচনার প্রসঙ্গ। সুমিতেশও বলত –“বস্তুতএকটিই লেখাআর এখান থেকেই কোথাও যেন বারবার নাড়া দিতে থাকে একটাই প্রশ্ন , তবে কি কবিমানসে শব্দের ব্যাকড্রপে লেগে থাকা বিম্ব অথবা প্রতিবিম্ব যাই বলো না কেন সেখানে কোথাও না কোথাও উপলব্ধি মানবীয় হতে বাধ্য! জীবনের আস্বাদ সেখানে রয়েছেঅভিজ্ঞতার দেশ সেখানে রয়েছে আর এসব নিয়েই , গ্রহের জীবন নিয়েই কি কবিতা চিরপলাতক! উদ্বেল! অস্থির!-অরুনকুমারের কবিতায় আমরা এই মনোস্বভাবটাই বারবার প্রত্যক্ষ করতে পারি। একধরনের ভাঙা গড়াআঁকড়ে থাকা থেকে নির্মল নিটোল একধরনের বিচ্ছিন্নতা। অরুণকুমার সরকার তার মাত্র দুটি কাব্যগ্রন্থে ধ্রুবপদের মত একটি প্রশান্ত বন্দর চেয়েছেন বারেবারে , যা একা যা শান্ত , যেখানে মোচড়ানোর মায়া নেইপ্রতীক্ষমাণ আঁধার নেই।

তাঁর কবিতায় শূন্যের মিহি মোটা কাপড় ঢাকা এক জমায়েতের গল্প। শিকড়কে স্থানচ্যুত করে চারাদের মুঠি ধরে টান দিয়ে বারবার অরুনকুমার যেন শূন্যের কোনো অরণ্যের দিকে পা বাড়িয়েই রয়েছেনতাঁর ভাষায় ভেসে রয়েছে একটা যাওয়া যাওয়া কুঞ্জ। কবিতার জন্য প্রতীক্ষার দরকার কিনা জানিনা কিন্তু একজন কবি কণার গভীরে পৌঁছোতে প্রবহমানে যে প্রতীক্ষাকে জীবনসাক্ষ্য করে তোলেন তা বোধহয় কবি অরুনকুমার সরকারের কবিতায় প্রকাশ পেয়েছে বারংবার। যে বাস্তব কঠিনযে বাস্তবতা ক্লান্ত সেখানে দাঁড়িয়ে একজন মানুষ যখন হন্যে হয়ে যখন খুঁজে বেড়াচ্ছেন একটি নিশ্চিত সদর দরজা ঠিক তখনই খন্ডকালের সীমানায় বাঁধা ওই মানুষকে কবির পাখি এসে ঠোঁটে নিয়ে পালিয়েছে খিড়কি জানলা দিয়ে। আর এই শাশ্বত জানলাটাই অরুণকুমার খোলা রেখেছিলেন তাঁর কবিতায়,প্রতীকের আবরণে।

কবি অরুণকুমার সরকারের শেষ কাব্যসংকলন –“যাও,উত্তরের হাওয়াআর তাঁকে নিয়ে দু চার কথা বলতে গিয়ে অপর এক কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তেরই ওই একই নামের একটি কবিতা মনে পড়ে যাচ্ছে। (আমার অপরাজেয় অযোনিজ বীর সন্তানেরা/সমুদ্রে খাটায় তাঁবুমরুবক্ষে বাঁধে স্নিগ্ধ ডেরা/সত্যকে সাজিয়ে করে সুন্দরের মতন অলীক।/যাও উত্তরের হাওয়াতাকে গিয়ে বলে এসো - আছে,/যৌবনের ধনুর্বাণ লুকোনো ইচ্ছের শমীগাছে।")-পার্থক্য কেবল একটাই-অলোকরঞ্জন যেখানে সম্ভাবনার কথা স্বপ্নপূরণের কথা গভীর আস্তিক্যের কথা উচ্চারণ করেছেন , যা অধিকাংশ শিল্পীরই কাঙ্খিত প্রেক্ষিত হয়ে ওঠে সেখানেই অরুণকুমার একটি প্রস্থান একটি নিরাশাবাদকে যেন প্রশ্রয় দিয়েছেন তাঁর সামগ্রিক কবিসত্তায় । কিংবা তাঁর ভাবনা অনুভাবনা অন্তপ্রেরণায় সুগ্রথিত হয়ে আছে  ফুল তুলতে তুলতে ফুলের ঝরে যাওয়ার মত কেবল একটি সুস্থতা। একটি শূন্যতা।

হয়ত ঘাস ও পাতার ফিসফিসানির মাঝে আধশোওয়া ওই শূন্যতারই কথার আজ শেষ নেই...

  
প্রার্থনা

যদি মরে যাই
ফুল হয়ে যেন ঝরে যাই;
যে-ফুলের নেই কোনো ফল
যে-ফুলের গন্ধই সম্বল;
যে-গন্ধের আয়ু এক দিন
উতরোল রাত্রিতে বিলীন;
যেই রাত্রি তোমারই দখলে
আমার সর্বস্ব নিয়ে জ্বলে,
আমার সত্তাকে করে ছাই ।
ফুল হয়ে যেন ঝরে যাই ।

ভাঙা গড়া

ছিঁড়ে ফেলো। কুটি কুটি করে ছিঁড়ে বাতাসে ওড়াও
যা কিছু সামান্য , তুচ্ছনিত্য-ব্যবহৃত ,গৃহস্থালি।
পুরনো চিঠির গুচ্ছহলদে-খামপঠিত বইয়ের মধ্যে
নিষ্পেষিত ফুলের একদা। এবং বর্তমানও
এই যে দুপুরএক নেশাগ্রস্ত বুড়োএর ঘাড় ভাঙো ।
দূর করো হাঁপানো বিকেল ।
ছিনাল সন্ধ্যাটাকে দুমড়ে দাও চিৎকারে চিৎকারে ।
স্বপ্নভুক রাত্রিটাকে আঘাতে আঘাতে খুন করো।
যা কিছু পুরনো,জীর্ণ,জঙধরা,কবজার,
যা কিছু আঁকড়ে থাকেজড়ায়ছড়ায়
ভাঙোছেঁড়ো।
তেমন শক্তি  যদি না-ই থাকে
অন্তত তুবড়ে দাও। আর
তখনই শুনতে পাবে ভেসে আসা গানজাদুমন্ত্র।
ফিরে আসবে পূর্ণ হয়ে সকালদুপুরসন্ধ্যা,
রাত্রির শরীর
গড়নটা ভিন্ন,অন্য নামকিন্তু নির্মল নিটোল ।

টান

কিছুই টানে না আরটেনে নিয়ে যায় না সাগরে।
পুকুরেডোবায় কেউবড় জোর নদীর কিনারে
যাবার প্রত্যাশা এনে মাঝপথে দারুণ হাঁপায় ।
দেখে কষ্ট হয় বড়বলি আচ্ছাআসব অন্যদিন ।

আবার শহরে ফিরে কড়া নাড়িঅমুক আছ হে ।
আছে। বেঁচেবর্তে আছে। চোখে কিন্তু জ্যোতি নেই আর
যদিও ভেঙেছে হাল,দড়াদড়ি খেয়ে গেছে কীটে,
নৌকার পাটায় গর্তপালে ফুটোদিক বদলেছে ।

আরেক পাড়ায় যাইউঠতি মাঝিমাল্লাদের ঘাটে।
দেখিয়ে ন্যাংটো পাঁজরা টানটান মালকোঁচা আঁটে
চোয়াড়ে ছোঁড়ার দল। তারপর চড়াদর হেঁকে
ডাঙায় ডিগবাজি খেয়ে ট্যাক থেকে বের করে বেঁকে
কোথায় সাগরএক সাগরের ছবি এলেবেলে।
সাক্ষাৎ সঙ্গম নাকি মারাত্মক রকম সেকেলে।

কিছুই টানে না আরটেনে নিয়ে যায় না সাগরে।

যাব না

অবচেতনার বৃক্ষে অনেক পুষ্প
আমি ঘুরে মরি বাইরে।
নিজেকে এড়াই পালিয়ে বেড়াই
কেন বিপরীত প্রান্তে
দক্ষিন দিকে যখন শান্তি নেমেছে ?

কেন বা জুয়ায় বাঁধা রাখি সর্বস্ব
মদে খুঁজি অবলুপ্তি
হাজার লোকের ভীড়ে খুঁজে পাই
কোন প্রশান্ত বন্দর?

কিছু নয়কিছু নেইশুধু চাই
যন্ত্রনা এক তীব্র
আত্মঘাতের বেদনায় নীল
অমোঘ বিষের পাত্র।
কেন চাই জানি না তা।

নিজেকে এড়াই পালিয়ে বেড়াই
যেখানে আলোর রাজ্যে
শুধু চিৎকার গানের বিকার
ঘর্ম রক্ত মাংস।

অবচেতনার বৃক্ষে অনেক পুষ্প
কিন্তু আমি তো যাব না অন্ধকারে
তুমি যে সেখানে অপেক্ষমাণ
মালতীলতার কুঞ্জে
যাব নাযাব নাযাব না অন্ধকারে ।

একটি কবিতা

সব কবিতাই পুনর্লিখিত কবিতা;
সেই ঘাসসেই আকাশমানুষ,নারী।
ভোরবেলাকার মাখন রঙের রোদে
প্রতিদিন তুমি নবনবরূপে এসো ।

কাছে আছে যারাপিছনে,দূরান্তরে
সকলেই মহাসমুদ্রপথযাত্রী;
সময়-স্রোতের আলোকে-অন্ধকারে
কেউ অদৃশ্যকেউ বা প্রতীয়মান ।

কিন্তু সবাই আছেসব কিছ আছে
যারা ছিল আগেআসবে আগামী দিনে
সব কিছু আছে ভোরবেলাকার রোদে
একটি কবিতা আবার জন্ম নিলে।

একটি কবিতা আবার লিখিত হয়
পুরনো শব্দকথার রূপান্তরে
ঈষৎ আলোক,ঈষৎ অন্ধকারে
প্রতিদিন তুমি নবনবরূপে এসো।

সদর দরজা

সে তার ভাবনাগুলোকে নিয়ে একটা বাড়ি বানাচ্ছিল;
কিছুতেই  মনঃপূত হচ্ছিল না সদর দরজাটা।
ভিতরের ঘরগুলো মোটামুটি দাঁড়িয়েছে একরকম
কিন্তু বাদ সাধছে খালি বেয়াদব সদর দরজাটা।

সদর দরজাটা কিছু মামুলি হলে তো চলবে না !
এখান দিয়েই ঢুকবে যাদের সে চমকে দিতে চায়
কড়া ইস্তিরির ভাঁজে,বিচ্ছুরিত উজ্জ্বল পালিশে।
সদর দরজাটা তাই কায়দামাফিক হওয়া চাই ।

বহু ভেবেচিন্তে দুটো ছফুট সাত ইঞ্চি দৈত্যকে
খোদাই করল দুই কপাটের ভারিক্কি গতরে।
হাতে গদা(অবশ্য সোনার) চোখে অগ্নি (দামী পাথরের)
দৈত্য দুটো হাঁকেডাকে খানদানি বলেই মনে হল।

পরম সন্তুষ্ট চিত্তে যেই না সে ঘরে ঢুকতে গেল,
দৈত্য দুটো গদা ঘুরিয়ে হাঁক ছাড়লতুম কৌন হ্যায় !
খিড়কির জানলাটা দিয়ে পাখি এসে ঠোঁটে করে তাকে
ভাগ্যিস পাচার করল নিরাপদ বকুলতলায় ।

ব্যবধান

তোমাদের গাঁটগুলো,
ক্ষমা করোবানানো বলেই মনে হয়
এমন সাহিত্য-ঘেঁষা নিরাপদ।
আমাদের জটিলতা পরিশুদ্ধ ছিল
ইতিহাস সাক্ষী দেবে।
এ-সব ধারনা কিছু পাকাচুল হয়তো বা। তবু
তুমি যত কুয়াশায় আমি হই সূর্যের শরীর।
সেটাই ভব্যতা তাই সরে যাই পশ্চিমের
ভাঙা বারান্দায়।
দেখি না কিছুই দেখি স্বপ্নে দেখি আমারই আভায়
তুমি দূর গ্রহ ঝিকমিক।

গুরুঠাকুরের ভাষণ

দাঁড়কাকে ঠুকরে খাবে নিতম্ব তোমার
ক্রিমিকীট বাসা বাঁধবে জ্যামিতিক খাঁজে,
থাকবে না একটুও ঝাঁজ তীক্ষ্ণ রসনার
সব রস নিঙড়ে নিলে যেমন পেঁয়াজে।

অতএব আরশি রেখে পার্শ্ববর্তীটিকে
অবুঝ খুকির মতো আঁচড়াও কামড়াও,
যতক্ষণ আকাশের রঙ থাকবে ফিকে
রভসে গোঙাও ফের রভসে গোঙাও।

ভোরবেলায় শুনতে পাবে পাখি ডাকছে ডালে
সেই যে ত্রিকালদর্শী ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমি;
বলছেঢের দুঃখ আছে তোর পোড়াকপালে
ব্যঞ্জনে অরুচি ধরবেপাতে করবি বমি।

তখন চৈতন্য হবেদেখবি অমৃত
এনেছে সামান্য চালকলা ও বাতাসা।
বুঝবি এ মনুষ্যজন্ম সুপরিকল্পিত
কৃষ্ণ ভজবার জন্যে সংসারেতে আসা ।

দাঁড়াও

দাঁড়াওদাঁড়াওআমি হাঁপিয়ে উঠছি আর
পারছি না দৌড়তেএকটু বসতে চাইএকটু হাঁটু মুড়ে
না হয় ঠেস দিয়ে ওই বটের গুঁড়িতে এই দু-চার মিনিট মাত্র
বসতে চাই কিম্বা দাঁড়াতে একটু দম নিতে দাওদাঁড়াও না

পায়ের গুলিতে টানবুকেতে প্রচন্ড ব্যাথাছাতি ফাটছে দারুন তৃষ্ণায়

ছুটছি সকাল থেকেছুটে আসছি দাঁতে দাঁত দিয়ে।
তোমরা কেউ কেউ অন্য মোড় ঘুরে কোথায় পালালে
তোমরা অনেকে কত দূরে কত ছোটো হয়ে গেলে
এখনও দেখতে পাচ্ছি ছুটে যাচ্ছছুটে যাচ্ছ,ছুটে যাচ্ছ। থামো।

এখন পড়ন্ত বেলা। তারপরই ধূ ধূ অন্ধকার।
বটতলার ছায়াঘুমশিকড়ের মাকড়সার জাল।
আমিও ছুটবআমি তোমাদেরই সঙ্গে সঙ্গে যাব
থামব না। আমিও যাবআমি যাবআমি যাবএকটু দাঁড়াও ।

ফেরার পথে

এই পথে যদি কেউ আসেই আবার
তাকে বোলো
যদি কেউ ভালবাসে গাছের ছায়ায়
আলোর আলপনা গাসে বাতাসের ঢেউ
তাকে বোলো
দূর গ্রামে কেউ নেই আর
পুকুরের পাড়ে বঊ তেঁতুলতলার হাট
কপাট সিঁদুরমাখা ছবি আঁকা মাদারের ফুল
কিছু নেই ধূলোর চিৎকার ।

এই পথ যাবে শূন্যের অরণ্যের নিরুদ্দেশে যাবে
হারাবে ভীরুতা প্রেম স্নেহের শপথ মাটি
মমতার খুঁটিনাটি বাগানের পরিপাটি মুখ
হারাবে ছড়াবে সবই রেখে যাবে মুক্তির অসুখ
রিক্ততার বেদনার চিহ্ন চেতনার।
তাকে বোলো।

শুধু প্রেম নয়

শুধু প্রেম নয়কিছু ঘৃণা রেখো মনে,
যেমন অনেক বৃক্ষ কোমলাঙ্গ কাঁটা দিয়ে ঢাকে ।
আছে লালসার দাঁতলোভের বিকট জিহ্বা,
প্রভুত্বের লোমশ লাঙুল
ব্যঙ্গের কুঠারঈর্ষাঅন্যায়ের সহসা ছোবল
সইবে কেমনে?
শুধু প্রেম নয় তাই যুগপৎ ঘৃণা রেখো মনে।

ক্ষমা মহাত্মার সজ্জা। তুমি আমি সাধারন লোক
ছোট কি মাঝারি গাছআমাদের দরিদ্র শরীরে
বর্ম কি বল্কল নেই কিংবা জ্যোতির্ময় গয়নাগাঁটি।
আমাদের ক্ষমা শুধু পিছু হটাচোখ বুজে থাকা,
দুর্বলতারই অন্য নাম।
চারিদিকে পশুদের নখদাঁত,তর্জনে-গর্জনে
ক্ষমা নয়প্রেম নয়কাঁটাবিষ,ঘৃণা রেখো মনে।

সাজে না অবজ্ঞা ক্ষমা অস্তিত্বই বিপন্ন যেকালে
অস্তিত্বের চেয়ে বড় আত্মসম্মানের ডালপালা ।
স্বপ্নের পাখির নীড় ছিন্নভিন্ন। শ্রাবণেও অনাবৃষ্টি হেনে
যারা কুঁড়ি ছেঁড়েযারা ফুলকে দেয় না দীর্ঘ সাধনার ফল
ফলকে দেয় না মাটি জল হাওয়া স্রষ্টার আসন,
শিকড়কে স্থানচ্যুত করেমুঠি ধরে টানে চারাদেরও

ঘৃণার বিষাক্ত রসে গাত্রদাহ হোক না তাদের
প্রতিবাদ করো নিষ্ঠীবনে ।
শুধু প্রেম নয়কিছু ঘৃণা রেখো মনে।

ভোর-গরবি

তিনটি ফুল যেন তিনটি বোন
বেগনি শাড়ি পরাবারান্দায়
সোনালি রোদ্দুরে সকালে সুহাসিনী ।

চকিতে জেগে ওঠা শিকারী যৌবন
রঙের তীর ছোড়ে কালোর পর্দায় ;
ছিল না কোনোদিন বালিকা বয়সিনী ।

আকাশের আধো আলোএখনো ঘুমঘোর
তিনটি বোন তবু সেরেছে প্রসাধন ।
শিশিরস্নাত দেহে কিসের প্রত্যাশা !

এখনই টেনে নেবে খুশিতে ফাঁসিডোর
পুরুষ সূর্যের মৃত্যুচুম্বন ।
আত্মঘাতী বুঝি প্রাকৃত ভালোবাসা ?


শেষ খুঁটিগুলো

শেষ খুঁটিগুলো খুব শক্ত করে ধরে রাখতে চাই।
একে একে বাড়ি ঘর ভেসে গেলে প্রবল জোয়ারে
ভাই গেল বন্ধু গেল পুত্র কন্যা পরিবার তাও
ক্রমেই অদৃশ্য হয়ে বাঁক নিল দূরবর্তী স্রোতে
শেষ খুঁটিগুলো খুব শক্ত করে ধরে রাখতে চাই।

শেষ খুঁটিগুলো খুব শক্ত করে ধরে রেখে দিয়ে
এ-বিশ্বাস নিয়ে যেন মৃত্যু হয় আমারঈশ্বর;
এইখানে একদিন মানুষেরা ঘর বেঁধেছিল
পুত্র কন্যা পরিবার ভাই বোন বন্ধু পরিজন নিয়ে
এইখানে একদিন মানুষেরা ঘর তুলবে এসে
নতুন খড়কুটো নিয়ে পরস্পরকে ভালোবেসে ।

শেষ খুঁটিগুলো খুব শক্ত করে ধরে রাখতে চাই।



 মুখবন্ধ ও গ্রন্থনা - রমিত দে 


My Blogger Tricks

3 comments:

  1. একটা অসাধারণ উপস্থাপন। কবি রমিত দে'কে কুর্নিশ জানাই। কবিতা গুলো সাজানো হয়েছে একদম অর্থ অনুসারে। তাই "শেষ খুৃটি "..একদম শেষে। প্রতিটি কবিতায় একটা চিরন্তন বক্তব্য আছে যা বলার জন্য একটা প্রচন্ড সাহস দরকার হয়। বিশেষ করে "একটি কবিতা "..একটা সাধারণ সত্যের অকপটচিত্ত। জটিলতায় সত্যি পরিশুদ্ধ ছিলো। প্রিয় কবির নামের তালিকায় কবি অরুণ বাবুর নাম সংযোজন হলো। বাক্, এর এই উদ্যোগ সত্যিই প্রশংসনীয়।

    ReplyDelete
  2. ধন‌্যবাদ অশেষ, ভালোবাসা।
    একটি কবিতা ও প্রার্থনা কবিতা দুটির পাঠ রেকর্ডিং করবো।
    ভালোবাসা।

    ReplyDelete
  3. এই কবিতা গুলির অর্থ বুঝতে হলে কী করতে হবে?🙂

    ReplyDelete